জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনায় প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদসংক্রান্ত প্রস্তাবনা প্রশ্নে ভিন্ন অবস্থান নিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো।
প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সর্বোচ্চ দুবারের প্রস্তাব করেছে অধিকাংশ দল। তবে দুবারের পর একবার বিরতি দিয়ে আবারও প্রধানমন্ত্রী হওয়া যাবে বলে কয়েকটি দল মত দিয়েছে। রোববার সকালে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমির মিলনায়তনে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের পঞ্চম দিনের সংলাপে এসব প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়।
এদিনের আলোচনায় অংশ নিয়েছে-বিএনপি, জামায়াত, সিপিবি, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, গণধিকার পরিষদ, গণসংহতিসহ ৩০টি রাজনৈতিক দল।
আলোচনায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, গণতান্ত্রিক চর্চা বন্ধ করা ঠিক হবে না। আলাদা আলাদা আলোচনা করে সমাধানে আসা কঠিন। আমরা তো সংস্কার চাই। তবে প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রের কোনো একটি বিভাগকে দুর্বল করে ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব হবে না। একজন স্বৈরাচার হয়েছিল। সেটি চিন্তা করে যদি সংস্কার করে হাত-পা বেঁধে দেওয়া হয় তাহলে সেটি ঠিক হবে না। দুই মেয়াদ হোক বা পাঁচ বছরের জন্য প্রধানমন্ত্রী হোক একজন কত বছর প্রধানমন্ত্রী থাকবেন সেটা আলোচনা করা যেতে পারে। তিনি বলেন, সংবিধানের মূলনীতির প্রশ্নে পঞ্চম সংশোধনীতে ফিরে যেতে চায় বিএনপি। সাম্য, মানবিক মর্যাদা, গণতন্ত্র ও সামাজিক সুবিচারের বিষয়গুলো সংবিধানে রাখতে বিএনপির আপত্তি নেই।
সালাহউদ্দিন আহমদ আরও বলেন, ঐকমত্য কমিশনের ফলাফল কী হবে তা বলতে চাই না। রাজনৈতিক দলগুলো একমত হতে না পারলে, জাতির জন্য তা হতাশাজনক হবে। অনেক বিষয়ে একমত হওয়া যাচ্ছে না উলেখ করে, ন্যূনতম বিষয়ে একমত হওয়া জরুরি বলেও তিনি অভিমত প্রকাশ করেন।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, সর্বোচ্চ দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু সেটি পূর্ণ মেয়াদ হতে হবে। কিন্তু কেউ মেয়াদ পূর্ণ করতে না পারলে সেটি অন্যভাবে বিবেচনায় নিতে হবে।
তিনি বলেন, যে কোনো ব্যক্তি জীবনে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সর্বোচ্চ ১০ বছর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন এ বিষয়ে রাজি জামায়াত। এর বেশি মেয়াদের ব্যাপারে জামায়াত রাজি নয়। ৫ বছর মেয়াদে দুবার কেউ পরিপূর্ণ মেয়াদ পূর্ণ করলে তিনি আর প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। দুনিয়ার বহু দেশে এমন নজির আছে। বাংলাদেশের জন্য এটা আমরা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করি।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, প্রধানমন্ত্রী কয় মেয়াদ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করতে পারবেন, সেটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রস্তাব ছিল, প্রধানমন্ত্রী সর্বোচ্চ দুবার শপথ নিতে পারবেন। নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব ছিল-প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ হবে দুটি। তিনি দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।
তিনি বলেন, এখন কয়বার ও মেয়াদ নিয়ে সমস্যার জায়গা তৈরি হয়েছে। মেয়াদ বলতে পূর্ণ ৫ বছর অথবা সংসদ যতদিন আছে, সেটি বোঝায়। আর দুবার বলতে বোঝায়, একই মেয়াদের মধ্যে দুবার হতে পারে। এমন জায়গা থেকে আলোচনা হয়েছে।
বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতি বাতিল চায় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটির যুগ্ম আহবায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে আমরা স্পষ্টভাবে জানিয়েছি, বাহাত্তরের মুজিববাদী মূলনীতি আমরা রাখার পক্ষে না। এ মূলনীতি বাদ দিতে হবে।’
এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারা বলেন, বর্তমান যে ব্যবস্থা আছে, সে ব্যবস্থা থেকে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদটা সীমিত করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল। এ ছাড়া একজন কত বছর ধরে প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন সে বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুবার শপথ নিতে পারবেন, এই জায়গায় আমরা সীমা নির্ধারণ করার কথা বলেছিলাম। কিন্তু ঐকমত্যের স্বার্থে সবাই সর্বোচ্চ ১০ বছর বলছে। সময় নির্ধারণে আমাদের মতামত ফেক্সিবল (নমনীয়) থাকবে।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ বলেন, পুরো মেয়াদ সম্পন্ন না করা নিয়ে বিতর্ক আছে। তা বাদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সর্বোচ্চ দুবার বিবেচিত হবে।
গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর দুই মেয়াদের সমর্থন আছে। এটায় সিদ্ধান্তে আসা উচিত। ইসলামী আন্দোলনের মুখপাত্র গাজী আতাউর রহমান বলেন, ঐকমত্যের স্বার্থে আমরা সর্বোচ্চ দুবারের পক্ষে। সংকটের মূল জায়গা নিম্নকক্ষ নির্বাচন পদ্ধতি। এনপিপির চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, একজন ব্যক্তি পরপর দুবার প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন। এরপর একবার বাদ দিয়ে আবার থাকতে পারবেন।
বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, একজন পরপর দুবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন। একবার গ্যাপ দিয়ে আবার দুবার দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। এভাবে যতবার খুশি ততবার হবেন।
আমজনতা দলের কার্যনির্বাহী সদস্য সাধনা মহল বলেন, এক ব্যক্তি দুবার প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন। একবার গ্যাপ দিয়ে আরেক মেয়াদে থাকতে পারবেন।
জাতীয় ঐকমত্যের স্বার্থে ছাড় চাইলেন আলী রীয়াজ: জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক দলগুলোকে আরও নমনীয় হওয়ার আহবান জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, আপনারা আসছেন, আরেকটু আগান। তাহলে জুলাই সনদ দ্রুত করা সম্ভব। কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের সংলাপের পঞ্চম দিনের সূচনা বক্তব্যে তিনি একথা বলেন।
আলী রীয়াজ বলেন, আমরা এখানে এসেছি একটি বিশেষ ও কঠিন বাস্তবতায় ১৬ বছরের সংগ্রাম, সহস্রাধিক মানুষের আত্মত্যাগ, অনেকের নিখোঁজ হওয়া ও নিপীড়নের প্রেক্ষাপটে। রাজনৈতিক দলগুলোরও অনেক ত্যাগ রয়েছে। তাই আসুন, সবাই মিলে সমঝোতার পথে এগিয়ে যাই।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচন ও বিচার প্রক্রিয়া সমান্তরালভাবে চলবে। তবে ঐকমত্যের জন্য দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে। আলোচনা চলাকালে নতুন নতুন মত আসছে, ফলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের আগে দলগুলোর নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আরও আলাপ প্রয়োজন। তিনি জানান, উচ্চকক্ষ গঠন, নারীদের প্রতিনিধিত্ব এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনসহ কিছু বিষয়ে এখনো ঐকমত্য হয়নি। এসব নিয়ে আগামী সপ্তাহে আবার আলোচনা হবে।
কেয়ামত পর্যন্ত ঐক্যের সম্ভাবনা নেই নুরুল হক নুর: জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে যেভাবে ঐকমত্যের বিষয়ে আলোচনা চলছে তাতে কেয়ামত পর্যন্তও শতভাগ ঐকমত্য হবে না বলে মন্তব্য করেছেন গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর। তিনি বলেন, মূল বিষয়গুলো গত ৩ দিনের মতো আজকেও অমীমাংসিত। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনার বিরতিতে তিনি এমন মন্তব্য করেন।
ঐকমত্যের সঙ্গে নিজেদের অনেক প্রস্তাব থেকে সরে এসেছেন বলে মন্তব্য করে নুরুল হক নুর আরও বলেন, অনেক বিষয়ে নিজেদের অবস্থান থেকে সরে এসে একমত হচ্ছি আমরা। কিন্তু এখানে কিছু কিছু দল একবারে নিজেদের অবস্থানে অনড়। ২ থেকে ৩টি দল তাদের পার্টির কনফার্মেশন নিতে হচ্ছে, দল থেকে ক্লিয়ারেন্স নিতে হচ্ছে। যদি এভাবে চলতে থাকে কেয়ামত পর্যন্ত কোনো ঐক্যের সম্ভাবনা দেখি না। কোনোভাবেই শতভাগ ঐক্যের জায়গা তৈরি হবে না।
এজন্য আমরা বারবার বলেছি, কতটুকু পর্যন্ত আলোচনায় একমত হলে তাকে ঐকমত্য বলবেন বা কতটি দল একমত থাকলে সেটাকে ঐক্য বলবেন এটার একটা মাপকাঠির ঐকমত্য কমিশনকে নির্ধারণ করা দরকার। আমরা ঐকমত্য কমিশনকে বলেছি আপনারা এখানে রেফারির ভ‚মিকায় আছেন, সবার আলাপ-আলোচনা শুনে আপনাদের একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে।
বৃহস্পতিবারের আলোচনায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ, সংবিধান ও রাষ্ট্রের মূলনীতি এবং নির্বাচনি এলাকা নির্ধারণ নিয়ে আলোচনা হয়।
0 coment rios: